গত ৪ আগস্ট প্রথম আলোতে প্রকাশিত রিপোর্টে সর্বপ্রথম দেখতে পেলাম যে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে মেডিকেল কলেজে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদর ভাগ্য। এব্যাপারে আমি শুরু থেকেই নজর রাখছি বাংলাদেশের গণমাধ্যমসহ ফেইসবুক, টুইটারের মত সোশাল মিডিয়াগুলোর মাধ্যমে। গত ১২ আগস্ট এব্যাপারে সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আমার পরিচিত অধিকাংশ মানুষই এর বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন। তবে কোন মতামতে পৌছানোর আগে আমাদের সবার মনে যে প্রশ্নগুলো জেগেছে সেগুলো নিয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন।
৪ আগস্ট প্রথম আলোতে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষদের নিয়ে বৈঠকে উঠে আসা ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের মূল কারণগুলো: (১) ৫০-৬০ হাজার শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া, (২) প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এড়ানো, (৩) “কোচিং বাণিজ্য” বন্ধ করা। অভিযোগগুলো সহজেই এড়ানো যায় কিছু পদক্ষেপ নিলে। যদি ভবিষ্যতে এসএসসি ও এইচএসসির সম্মিলিত ন্যূনতম জিপিএ’র মান ৯ বা ৯.৫ করা হয় এবং একই জিপিএর ক্ষেত্রে বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার আদলে জীববিজ্ঞান, রসায়নের মত বিষয়গুলোর জিপিএ দেখা হয় তাহলে এরকম বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নিতে হবে না। (এমনিতেও প্রস্তাবিত নিয়মে মোট জিপিএ ৯ তো দূরে থাক, অনেক ১০ প্রাপ্তরাও সুযোগ পাবেনা। ) আর প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বলা হয় যে প্রশ্ন ফাঁস হয় প্রেসে ছাপানোর সময় এবং প্রেস থেকে দূরবর্তী কেন্দ্রে পাঠানোর সময়। এই অভিযোগও সম্পূর্ণভাবে এড়ানো সম্ভব যদি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। খুব সহজেই আগের রাতে প্রশ্ন তৈরী করে নির্দিষ্ট কেন্দ্রের প্রধানের কাছে প্রশ্নপত্র ইমেইল করা সম্ভব। এরপর প্রশ্ন পরীক্ষার আগের রাতে যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্থানীয় যেকোন প্রেসে সহজেই ছাপানো সম্ভব। ফলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও দুষ্কৃতিকারীরা তা বিতরণের জন্য যথেষ্ট সময় পাবে না। আর সবশেষে বলব কোচিং বাণিজ্যের বিষয়টি সরকার চাইলেই আইন করে বা এইচএসসির ফলাফলের কয়েক সপ্তাহের ভেতর দ্রুত ভর্তি পরীক্ষার আয়োজনের মাধ্যমে বন্ধ করতে পারেন। আর এইবছরের কোচিং বাণিজ্য যা হওয়ার তা এরই মধ্যে হয়ে গেছে, তাছাড়া ভর্তি কোচিং বাতিল করলে এসব কোচিং হয়ত ভোল পাল্টে পাবলিক পরীক্ষার প্রস্তুতি কোচিং খুলবে! তাই এই তিনটি সমস্যার কারণে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল কতটা যৌক্তিক সেটা ভাববার বিষয়।
মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রকাশিত সাক্ষাতকারে বলেছেন যে উপরের কারণ গুলো আসলে মূল কারণ নয়, বরং তাঁর প্রশ্ন: শুধু শুধু কেন একটা অতিরিক্ত পরীক্ষার আয়োজন করবেন? আমি বলব, কারণ পাবলিক পরীক্ষা দিয়ে সম্পূর্ণভাবে একজন শিক্ষার্থী যোগ্য কিনা তা যাচাই করা যাবে না। আমি কিন্তু এখানে বলছিনা একেবারেই করা সম্ভব নয়—কারণ যে শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে সে যথেষ্ট কষ্ট ও পরিশ্রম করেই এই ফলাফল করেছে—তার মেধা এবং কৃতিত্বকে খাট করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু কী কারণে এটা যথেষ্ট নয় সেই যুক্তিগুলোই আমি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
পাবলিক পরীক্ষার মূল সমস্যা হল এটি প্রমিত (standardized) নয়–দেশের আটটি বোর্ডে আট ধরণের প্রশ্ন হচ্ছে। আর মাদ্রাসা বোর্ড এবং ইংরেজী মাধ্যমের ক্ষেত্রে তো প্রশ্ন এবং পরীক্ষা পদ্ধতিই আলাদা। তারচেয়েও বড় কথা আমাদের দেশে পরীক্ষায় বিভিন্ন বোর্ডের প্রশ্নের মান এবং কাঠিন্য (difficulty) সমান করার যেমন ব্যবস্থা নেই, তেমনিভাবে খাতা দেখার ক্ষেত্রে নম্বর প্রদানেরও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা (marking-scheme) নেই। সেকারণে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষকের কাছে একই খাতা গেলে নম্বর যে ভিন্ন আসবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এবছর এইচএসসিএত জিপিএ ৫ পেয়েছে ৫১,৪৫৯ জন। এদের বড় একটা অংশ যেহেতু ভর্তি হতে চাইবে মেডিকলে কলেজগুলিতে, সরাসরি জিপিএর ভিত্তিতে তিন হাজারের মত আসনের বিপরীতে তাদেরকে ভর্তি নেওয়া সম্ভব নয়। বর্তমান নীতিতে তখন দেখা হবে কাদের চতুর্থ বিষয় বাদে জিপিএ ৫। ফলে কোন শিক্ষার্থী যদি বিজ্ঞানের কোন বিষয় (যেমন: জীববিজ্ঞান) চতুর্থ বিষয় হিসেবে নেয় তবে বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয় তথা মেডিকেলের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর চেয়ে বাংলা, ইংরেজী, বা সামাজিক বিজ্ঞানের মত বিষয়ের স্কোর বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ফলে একজন শিক্ষার্থী হয়ত বাংলায় আরেকজনের থেকে বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে! তাছাড়া এসএসসি, এইচএসসি মিলিয়ে চতুর্থ বিষয় বাদে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজারের মত। তাই কেবল জিপিএ’র ভিত্তিতে কখনোই তাদেরকে ভর্তি নেওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন যে পরীক্ষায় প্রাপ্ত মোট নম্বর দেখা হবে (এমনকী বয়সও বিবেচনা করা হতে পারে!)। তাই যেখানে মোট নম্বর বিবেচনা করার ফলে হয়ত ১ নম্বরের জন্য শত শত শিক্ষার্থী বাদ পড়বে, সেখানে প্রমিত নয় এমন পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে কখনোই সঠিকভাবে বাছাই সম্ভব নয়।
আরেকটি সমস্যা হল পাবলিক পরীক্ষাগুলো সাজেশন নির্ভর হয়ে পড়েছে। অনেক ছাত্রকেই দেখেছি শর্ট সাজেশন থেকে হাতে গোণা কয়েকটি প্রশ্ন মুখস্হ করে বা গণিতে নির্দিষ্ট কয়েকটি সমস্যা সমাধান করে (যা অনেক ক্ষেত্রে মূল বইয়ের ২০%-এরও কম অংশ) পাবলিক পরীক্ষাতে ভাল করতে। এমনকি শহরের অনেক বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন মূল টেক্টট বইয়ের পরিবর্তে শর্ট সাজেশনের ভিত্তিতে বানানো গাইড পড়ানো হয়! (গতবছর আমার এক আত্মীয়র কাছে এরকম একটা বই দেখে হতাবাক হয়েছিলাম।) আর গ্রাম আর শহরের পার্থক্যের যে বিষয়টি দেখা যাচ্ছে তা কিন্তু এখান থেকেই আসছে। কারণ গ্রামের বা মফস্বলের ভাল শিক্ষার্থীর পক্ষে এধরণের সাজেশন, গাইডলাইন পাওয়া সম্ভব নয়, আর পরীক্ষাকে এভাবে গেমিং করাও সম্ভব নয়। তাই দেখা যাচ্ছে টেস্ট পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্টের পরও শহরের অনেক শিক্ষার্থী তিনমাস পড়াশোনা করে জিপিএ ৫ পাচ্ছে। অন্যদিকে একথা কারো অজানা নয় যে ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে এরকম সাজেশন নির্ভর পড়াশোনা করে কোনভাবেই ভাল করা সম্ভব না। কারণ ভর্তি পরীক্ষায় ভাল করতে একজন শিক্ষার্থীকে বইয়ের শতভাগ অনুশীলন করেই যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। তাই যে পাবলিক পরীক্ষাকে ১২ বছরের লেখাপড়ার ফল বলা হচ্ছে তা আসলে কতটা মানসম্পন্ন সেটা ভেবে দেখা দরকার।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাকালে দেখা যায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সেখানে SAT, TOEFL, বা IELTS এর মত পরীক্ষা দিতে হয়। উল্লেখ্য ২০০৫ সালে যখন SAT-এর ক্ষেত্রে নতুন প্রশ্ন পদ্ধতির চালু হল তার ৫ বছর আগে থেকে তারা ঘোষণা দিয়ে এবং নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার করেই তারা নতুন পদ্ধতি চালু করেছিল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় আমাকে পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি SAT দিয়েই ভর্তির জন্য নির্বাচিত হতে হয়েছিল। আর এই SAT এর ক্ষেত্রে যে সাবজেক্ট টেস্ট (পদার্থ, গণিত, এবং রসায়নের জন্য) দিতে হয়েছিল সেগুলো সবই ছিল ১ ঘন্টাব্যাপী এমসিকিউ পরীক্ষা। এই ফাঁকে বলে রাখি, পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে আমার কেবল এইচএসসিতে বাংলা বাদে আর সববিষয়ে জিপিএ ৫ ছিল। সবাই জানেন যে বাংলায় একেক শিক্ষক একেকরকম নম্বর প্রদান করেন বলে বাংলায় জিপিএ ৫ পাওয়া অনেকটাই ভাগ্যের ব্যাপার। তাই হার্ভার্ডের মত বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্য হলেও প্রস্তাবিত নিয়ম অনুসারে এদেশের কোন মেডিকেল কলেজে পড়ার জন্য আমি নিশ্চিতভাবেই অযোগ্য বিবেচিত হতাম!
প্রশ্ন হতে পারে যদি আমি মনেই করি পাবলিক পরীক্ষা দিয়ে যথাযথ মান যাচাই সম্ভব নয় তাহলে পাবলিক পরীক্ষার দরকার কী? দরকার প্রাথমিক ছাঁকনী হিসেবে। ৮০ ঘন্টার পাবলিক পরীক্ষার অবশ্যই মূল্য আছে (এবং বিগত বছরগুলোতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ৫০% নম্বর দেওয়া হয় জিপিএ’র ভিত্তিতে—যা সম্পূর্ণ যৌক্তিক)। প্রশ্ন কাঠামোর কারণে সব ত্রুটিমুক্ত করে ফেলার পরও কিন্তু পাবলিক পরীক্ষা দিয়ে সম্পূর্ণ নিখুঁতভাবে পরীক্ষার্থীর মেধা যাচাই সম্ভব নয়। তাই এখানে সংক্ষিপ্ত ফরমেটের ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে দুই স্তরের ছাঁকনীর মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে যে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে তারা প্রকৃতই যোগ্য।
সর্বশেষ সংবাদে জানলাম হাইকোর্ট মেডিকেল ভর্তি নিয়ে সরকারের উপর রুল জারি করেছেন। মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন যে এ ব্যাপারে আদালত রায় দেওয়ার আগে তাঁর কিছুই করার নেই। কিন্তু আসলেই কি তাই? গত ১৪ আগস্ট প্রথম আলোতে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত করছি, আদালত বলেছেন “[...] রুল দেওয়া হচ্ছে। যদি নোটিফিকেশন [ভর্তি পরীক্ষার সরকারী বিজ্ঞপ্তি] না হয়ে থাকে, তাহলে রুল অকার্যকর হয়ে যাবে।” যেহেতু ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করতে বাধা নেই, সকল আইনী জটিলতা বাদ দিয়ে মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী চাইলেই সবদিক বিবেচনা করা ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করতে পারেন।
সবশেষে এটাই বলব যে পাবলিক পরীক্ষা এবং ভর্তি পরীক্ষা একে অপরের পরিপূরক। সেকারণে এই পরীক্ষাগুলোর কোনটাকে বাদ না দিয়ে দুই ধরণের পরীক্ষারই মান উন্নয়নের দিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার। দেখা দরকার ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের মান যেন উন্নত হয় এবং তাতে যেন শুধু মুখস্থ বিদ্যা নয়, মৌলিক বিষয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরীক্ষাও হয়। তবে শিক্ষার্থীদের আগে থেকে জানিয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুত না করে হঠাৎ করে সবদিক না ভেবেচিন্তে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে একটি সিদ্ধান্ত দেওয়া হলে তা শিক্ষার্থীদের এবং দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য কতটা মঙ্গল বয়ে আনবে তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
-তারিক আদনান মুন
গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞান, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়
(২৪ আগস্ট ২০১২ তারিখে এই আর্টিকেলটি সংক্ষেপিত আকারে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়।)